যে গুনাহ জিনা’র চেয়েও ভয়াবহ
ইসলাম শান্তির ধর্ম। কমিউনিটিতে শান্তি-শৃংঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ইসলামের দিকনির্দেশনা জোড়ালো। সোহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য গীবত বা পরনিন্দা হারাম করা হয়েছে। গীবতের কারণে সমাজে নানা ধরনের অনর্থ, কলহ প্রস্তুত হয়।
গীবতের পরিচয়: গীবতের শাব্দিক টাকা-পয়সা হল, দোষারোপ করা, অনুপস্থিত থাকা, পরচর্চা করা, পরনিন্দা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে সমালোচনা করা ইত্যাদি। পরিভাষায় গীবত জানানো হয় ‘তোমার কোনো ভাইয়ের পেছনে তার এইরকম ভুলের কথা উল্লেখ করা যা সে লুকানো রেখেছে অথবা যাহার উল্লেখ সে অপছন্দ করে।’ (মুজামুল ওয়াসিত)
গীবতের সবচেয়ে যথোপযুক্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিচের হাদিস থেকে বোঝা যায়। সাহাবি আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গীবত কাকে বলে, তোমরা কি জান? সাহাবিগণ বললেন, রব এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ভালো জানেন। উনি বললেন, তোমার কোনো ভাই সম্মন্ধে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যে ভুলের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের ভিতরে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যে ভুলের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি নিশ্চয়ই তার গীবত করলে। আর তুমি যা বলছ তা যদি তার ভিতরে না থাকে। তবে তুমি তার উপর ভিত্তিহীন অপবাদ দিয়েছ। (সহিহ মুসলিম : ৬২৬৫)
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ গীবতের ভয়ানক পরিণাম বুঝাতে ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা একে অপরের গীবত করোনা। তোমাদের কেউ কি এটি পছন্দ করবে যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে। নিশ্চয়ই তোমরা এটাকে অপছন্দ করবে। আর তোমরা খোদাকে ভয় করো। নিশ্চই খোদা তাআলা সিমাহীন ক্ষমাকারী ও অতীব দয়ালু।’ (সূরা হুজরাত : আয়াত : ১২)
পরনিন্দা ইসলামি শরিয়তে হারাম। সাংঘাতিক কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। মহান স্রষ্টা বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে ভ্রান্তি বলে বেড়ায়।’ (সূরা হুমাজাহ : আয়াত:১)
কেউ গীবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধ করবে সাধ্যমতো। আর যদি প্রতিরোধের শক্তি না থাকে তবে তা শ্রবণ হতে বিরত থাকবে। কেননা, স্বইচ্ছায় গীবত শোনা নিজে গীবত করার মতোই অপরাধ। হাদিসে আছে, সাহাবি মায়মুন রা. বলেন, ‘একদিন স্বপ্নে দেখলাম এক সঙ্গী ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে ও এক মানুষ আমাকে তা ভক্ষণ করতে বলছে। আমি বললাম, আমি কিসের জন্য ভক্ষণ করব? সে বলল, কারণ তুমি অমুক ব্যক্তির মিত্র গোলামের গীবত করেছ। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তো তার সম্মন্ধে কক্ষনো কোনো ভালোমন্দ কথা বলিনি। সে বলল, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক। তা সত্ত্বেও তুমি তার গীবত শুনেছ ও সম্মত রয়েছ।’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মিরাজের সময় আমাকে এইরকম এক সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখম-ল ও দেহ আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিবরাইল আ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা স্বীয় ভাইদের গীবত করত এবং ইজ্জতহানি করত। (তাফসিরে মাজহারি)
আবু সায়িদ ও জাবের রা. হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘গীবত ব্যাভিচারের চেয়েও গুরুতর গুনাহ। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, এটি কিভাবে? তিনি বললেন, মানুষ ব্যভিচার করার পর তওবা করলে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়। তবুও গীবত যে করে তার গোনাহ আক্রান্ত প্রতিপক্ষের ক্ষমা না করা পর্যন্ত মাফ হয় না।’
গীবতের ভয়াবহতা বুঝানোর জন্যেই অনুরূপ এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “গীবত করা জিনা থেকেও মারাত্মক।” (সুনানে বায়হাকি)
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইটা সমাধির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেন, এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের সবাইকে তেমন বড় কোনো ক্রাইমে শাস্তি দেওয়া হলো না (যা পালন করা তাদের পক্ষে বিরক্তিকর ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চুগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হলো পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারণে। (সহিহ বুখারি)
গীবতের ভয়ঙ্কর শাস্তি হতে বাঁচার জন্য প্রভাতে নিদ্রা হতে উঠার সাথে সাথেই জিহবাকে সর্তক করে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যখন সকালে নিদ্রা হতে জাগ্রত হয় সেই সময় শরীরের সব শরীর জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে খোদাকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমাণী কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি নির্ভুল থাক, কিন্তু আমরা ঠিক রাস্তায় থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা রাস্তায় চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। (সুনানে তিরমিযী)
যে মানুষ তার জিহবার দায়িত্ব নিবে। অর্থাৎ সঠিকভাবে ব্যবহার করবে, তার জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে মানুষ আমার জন্য তার জিহ্বা এবং লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ (সহিহ বুখারি)
গীবত নিঃসন্দেহে হারাম। তারপরও যাদের ভুল ব্যাখা করা যায় তা হচ্ছে-
কোনো অত্যাচারীর নির্যাতনের কাহিনী প্রতিকারের আশায় বর্ণনা করা।
সন্তান এবং স্ত্রীর বিরুদ্ধে তার জনক ও স্বামীর কাছে অভিযোগ করা।
ফতোয়া ধারণ করার জন্য ঘটনার বিবরণ দেয়া, প্রয়োজন এবং উপযোগিতার কারণে কারো দোষ বর্ণনা করা জরুরি।
গীবত হতে বেঁচে থাকার উপায়
গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যক। এই হতে বাঁচার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। তলে তা উল্লেখ করা হলো।
১. অন্যজনের উপকার কামনা করা। কেননা, রাসূল সা. বলেছেন, ‘দীন হলো সাহায্য কামনা করা।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)
২. আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া। মহান খোদা এই গুণের অধিকারীদের প্রশংসা করে বলেছেন-‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অভাবের ভিতরে থাকে।’ (সূরা হাশর : আয়াত : ৯)
৩. অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া।
৪. মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বহু করে অধ্যয়ন করা।
মহান রব আমাদেরকে সবধরনের বদাভ্যাস থেকে বেঁচে থেকে, অনেক ভালো ও সুকুমার গুণগুলো জাগ্রত করুক। আর বিশেষভাবে গীবতের মতো ভয়ানক গুনাহ হতে বেঁচে থাকার তাওফিক অৰ্পণ করুন। আমিন।
বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) যে ভাবে শয়তানকে বোকা বানিয়েছিলেন!
একবার এক মরুপ্রান্তরে হযরত বড়পীর (রহ.) ভ্রমণ করছিলেন। ইবাদত-বন্দেগী ও ধ্যানসাধনার এক বিশেষ ক্ষণে হতে আওয়াজ এলো! হে আবদুল কাদের আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। সাধনার মাধ্যমে তুমি আজ এরূপ এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছ যে, আমি আল্লাহ তোমার প্রতি সুখী হয়ে গিয়েছি। অতএব, সম্প্রতি হতে শরীয়তের কোন আইন তোমার উপর বাধ্যতামূলক নেই। তুমি প্রার্থনা কর বা না কর, এতে কয়েকটি আসবে যাবে না। যে কোন ধরনের কাজে তুমি ইদানিং হতে স্বাধীন। এই ধরনের কথা শুনে হযরত জিলানী (রহ.) প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে ‘লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়লেন। আওয়াজটি অফ হয়ে গেল। উনি বলতে লাগলেন হে অভিশপ্ত শয়তান, তোর কুমন্ত্রণা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। তোর এ প্রস্তাব শুনতেই আমি বুঝতে পেরেছি যে, এই তোর ভয়ঙ্কর কৌশল। আমকে পথচ্যুত করার এক গুরুতর কূটচাল। কেননা, পবিত্র কোরআনে আছে, রব কোন মানব সন্তানের সাথে সরাসরি কথা বলেন না। তাছাড়া সাধনার কোন পর্যায়েই ইবাদত-বন্দেগীর দায়িত্ব কারো ওপর থেকে তুলে নেয়া হয় না। শরীয়ত অমান্য করার নির্দেশ খোদা কোন ব্যক্তিকে দেন না। তোর আওয়াজ শোনামাত্রই আমি বুঝতে পেরেছি যে, এইরকম বাক্য আল্লাহর দিক থেকে আসতে পারে না। এই নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল। এ কথা শুনে শয়তান বলল, এ ধরনের কথা বলা হয়ে থাকে এর প্রথমে আমি এই প্রান্তরেই কমপক্ষে ২৭ মনুষ্য সাধকের করেছি। আজ আপনি নিজ প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও উচ্চপর্যায়ের সাধনাবলেই রক্ষা পেয়ে গেলেন, হে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী।
তখন এ কথা শুনে হযরত জিলানী (রহ.) আবার পড়লেন ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। অর্থাৎ আল্লাহর খাস রহমত ছাড়া বুদ্ধিমান প্রতারক শয়তান হতে বেঁচে থাকার কোন শক্তি এবং ক্ষমতা আমার নেই।
শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা পাওয়ারও দোয়া আল্লাহর প্রিয় নবী (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। হযরত জিলানী (রহ.) এ দোয়া পড়ে বলতে লাগলেন, ঘটনার সম্পন্ন অংশে এসে তুই আমাকে নব করে আবার ধোঁকা দেয়ার ট্রাই করছিস হে বিতাড়িত শয়তান। তুই বুঝাতে চাইছিস যে, আমার জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাধ্যমে আমি রক্ষা পেয়েছি। তবুও আমি যে দোয়াটি পড়েছি, এতে রয়েছে ‘আল্লাহর সহযোগিতা ও করুনা ছাড়া রক্ষার কোন পদ্ধতি বান্দার নেই। এই মন্তব্য শুনে শয়তান বলল, সত্যিই আপনি আল্লাহর যথাৰ্থ খাস বান্দা। কোনভাবেই আমি আপনাকে খোদাবিমুখ করতে পারলাম না। একথা বলে শয়তান ব্যর্থ হয়ে সরে সরে গেল।
ভালো লাগলে সবার সঙ্গে শেয়ার করুন।
0 মন্তব্যসমূহ